📍 হাফিজ রহমান
১৯৯৫ সালের শুরুর দিকের কথা। সবুজ প্রকৃতির কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম, তিন পাশ ঘিরে পুরোনো বাঁশবাগান আর এক পাশে ইতিহাসখ্যাত বিশাল বিল—বলধালি বিল। গ্রামের মাটির রাস্তার দুপাশে সারি সারি আম, জাম, কাঁঠাল, বাবলা আর শিরিষ গাছের ছায়া। সন্ধ্যার পর কেরোসিন বাতির আলোয় ঝলমল করত গ্রাম। শিয়ালের ডাক আর বাঁশবাগানের সোঁদা গন্ধে সন্ধ্যার পরপরই এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি হতো।
ঈদের সময় ছিলো আলাদা এক উন্মাদনা। ২৯ রমজানের সন্ধ্যায় সবাই দল বেঁধে বিলের ধারে চাঁদ দেখতে যেত। বয়সে ছোট বড় সবাই একসাথে অপেক্ষা করত নতুন চাঁদ দেখার জন্য। শিশুদের আনন্দ ছিলো অন্যরকম, কারণ ঈদের চাঁদ মানেই নতুন জামা, মিষ্টি খাবার, এবং সীমাহীন আনন্দের সূচনা।
রাশেদ, জুলু, মিলু, বিলু—ওরা সবাই মিলে আজও ছুটেছে বিলের দিকে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে, সবার চোখ পশ্চিম আকাশে। একটু পরেই সূর্য অস্ত যাবে, তারপর দেখা যাবে ঈদের নতুন চাঁদ। কিন্তু ছোটদের ধৈর্য কই? চাঁদ ওঠার আগেই রাশেদ চিৎকার করে উঠলো, "ঐ যে চাঁদ উঠেছে!"
এই কথায় মুহূর্তের মধ্যে জনতার মাঝে হৈচৈ পড়ে গেল। বৃদ্ধ থেকে তরুণ সবাই উল্টো-পাল্টা হয়ে গেলো চাঁদ দেখার আশায়। কিন্তু কোথাও চাঁদ নেই! তখনই তসের আলী চাচা রাশেদের কান ধরে বললেন, "এই পোলাপান মানুষ হবে না, সারা গ্রাম ধোঁকা দিচ্ছে।"
রাশেদ ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, "আমি আর কখনো চাঁদ দেখতে আসবো না, কাল ঈদও করবো না!"
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সত্যিই আকাশে চাঁদ উঠলো! এবার সত্যি সত্যিই সবাই দেখলো নতুন চাঁদ, ঘোষণা হলো ঈদের। এখন আনন্দে ভরে উঠলো পুরো গ্রাম। সবার মুখে হাসি, ছোটরা দৌঁড়ে বাড়ির দিকে ছুটছে আনন্দের বার্তা নিয়ে।
গ্রামটি আর আগের মতো নেই। এখন সেখানে পাকা রাস্তা, মোবাইল টাওয়ার, আর ইন্টারনেটের আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। রাশেদ এখন ঢাকায় কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে, বিলু স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করছে।
কিন্তু এখন আর কেউ ঈদের চাঁদ দেখতে আকাশের দিকে তাকায় না, সবাই টেলিভিশনে দেখে ঈদের তারিখ নিশ্চিত করে। আগের মতো দল বেঁধে জামা কেনার দিনও নেই, এখন সবাই অনলাইন শপিং করে।
নামাজ শেষে প্রতিবেশীদের সাথে কোলাকুলি করা তো দূরের কথা, এখন ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হয় শুধু ডিজিটাল বার্তায়—"ঈদ মোবারক" লিখে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেউ কারো বাসায় যায় না, মায়েরা একা বসে পুরোনো ঈদের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
রাশেদের মা ঈদের দিন সকালে তাকিয়ে থাকেন দরজার দিকে, মনে পড়ে পুরোনো ঈদের স্মৃতি। "আগের মতো ঈদ কি আর কখনো আসবে না?"—তার এই প্রশ্ন রাশেদকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
সে ভাবে, তখন প্রযুক্তি ছিলো না, কিন্তু মানুষ একে অপরের খুব কাছাকাছি ছিলো। এখন ডিজিটাল পৃথিবীতে থেকেও মানুষ একা হয়ে গেছে।
আজ ঈদের দিন বিকেলে রাশেদ সিদ্ধান্ত নেয়, "পরের ঈদটা হবে পুরোনো দিনের মতো। আমি নিজেই চাঁদ দেখবো, প্রতিবেশীদের সাথে কোলাকুলি করবো, ছোটদের সালামি দেবো, পরিবারের সবাইকে একত্রিত করবো ইনশাআল্লাহ!"
তার মায়ের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি বলেন, "বাবা, চেষ্টা করো। মানুষকে কাছাকাছি আনতে হবে, আমাদের ঈদের আনন্দ ফিরে পেতে হবে।"
রাশেদ জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে, লালটুকটুকে নতুন সূর্য উঠছে। নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে—এক নতুন ঈদের, যেখানে থাকবে আন্তরিকতা, ভালোবাসা, আর সত্যিকারের ঈদের আনন্দ।